






প্রা’ণঘাতী করো’নাভাই’রাসে আ’ক্রান্ত হয়ে মৃ’ত্যুর তালিকা প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে। স্বজন হা’রানোর বুক ফাটা আর্তনাদে প্রতিদিনই ভা’রী হয়ে উঠছে আকাশ। এমন ম’র্মস্প’র্শী ঘ’টনার বর্ণনা করেছেন মুর্শেদ বিপুল নামে এক যুবক। সম্প্রতি মাকে হা’রিয়েছেন তিনি।
গত ১৪ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে মায়ের ছবিসহ একটি স্ট্যাটাসে ঘ’টনার বর্ণনা দিয়েছেন মুর্শেদ বিপুল।স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ছবিটি ১৫ মা’র্চ তোলা। বেশি দিন আগে না, মাত্র ৩০ দিন।







স্ট্রোক করার ৮ দিন পর আব্বুকে দ্বিতীয় বারের মতো ই’মা’রজেন্সিতে নিয়ে এসেছে আম্মু। স্কয়ার হাসপাতা’লের ই’মা’রজেন্সিতে তখন কোনো অজানা কারণে তিল ধারণের জায়গা নেই। ভে’তরে আব্বু নার্ভের ব্য’থায় আর্তকরছে।
সেই দৃশ্য সহ্য করার ক্ষ’মতা চ্যালেঞ্জ না করে আমি বোকার মতো ই’মা’রজেন্সি রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম, আম্মু আমা’র দিকে তাকিয়ে আছে। কী’ মনে হলো, ফোন বের করে ইনস্ট্রাগ্রামের জন্য ছবিটি তুললাম। ক্যাপশন দিয়েছিলাম ‘আম্মু, কিছু বলবেন?’







মুর্শেদ বিপুল লেখেন, ওই দিন আমা’র ছোট ভাইটির জ’ন্ম’দিন ছিল। আম্মুর সারা বছরের উত্তে’জনা থাকতো আমাদের দুই ভাইয়ের জ’ন্ম’দিন নিয়ে। রাতে খাওয়ার পর কেক কে’টে একস’ঙ্গে ছবি তোলা। আম্মু ফ্রিজে কেকটি রেখে এসেছিল। আমি তখনও বুঝতে পারিনি, এটাই আমা’র তোলা আম্মুর শেষ ছবি!
চিন্তা-অবসাদ মাখা ওই চোখ দুটো কী’ ভাবছিল তখন? ‘এর ৭ দিন পর আম্মু অ’সুস্থ হয়। প্রচণ্ড জ্বর-কাশি, না খেতে পারায় সুগার লেভেল ৩ এর নিচে নেমে যায়। এক পর্যায়ে বার’ডেম হাসপাতা’লে ভর্তি করা হয়।







২৭ তারিখ দরজা থেকে বিদায় নেওয়ার সময়ও আম্মু স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা নিয়ে বাসার এটা-সেটা বুঝিয়ে হাসিমুখে দুই হাত তুলে বলেছিল, ‘আসি’। ৩০ তারিখ রাত ৯টা, আম্মুকে আইসিইউতে স্থা’নান্তরিত করেন চিকিৎসকরা।
ঠিক দরজা বন্ধ করে দেওয়ার আগ মুহূর্তেও আমা’র গোছানো আম্মু সাবিনাকে এটা-সেটা বলছিল; ফোন, পার্স-ক্রেডিট কার্ড বুঝিয়ে দিচ্ছিল। রাত ১২টায় আম্মুকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। একা, দিশেহারা সাবিনা ডাক্তারকে বহু অনুরোধ করে আইসিইউতে ঢুকেছিল আম্মুকে দেখবে বলে। ততক্ষণে আম্মুর আর জ্ঞান নেই।’







তিনি লেখেন, আম্মুর গরমে অনেক ক’ষ্ট হতো। কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাত ৮টার সময়ও সাবিনা যখন আম্মুকে রাতের খাবার খাওয়াচ্ছিল, আমি কল করে বলেছিলাম, ‘আমাকে আম্মুর একটা ছবি তুলে পাঠিও, আমি আম্মুকে একটু দেখব।
সেই শেষ ছবিতে আম্মু ওয়ার্ডের বিছানায় মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া অবস্থায় চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ওই দিন এই শহরে প্রচণ্ড গরম পড়েছিল! এর একদিন আগেই আমি এবং দানিয়েল করো’না পজিটিভ শুনে আম্মু অস্থির হয়ে বার বার সাবিনাকে এবং নিশিকে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরত যেতে বলেছিল।
আমি আম্মুকে ফোন করে অনেক বকাঝকা করেছিলাম। আম্মু জো’রে জো’রে শ্বা’স নিতে নিতে মন খা’রাপ করে বলেছিল, ‘আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি’। সেটাই আম্মুর স’ঙ্গে আমা’র শেষ কথা!
আমা’র হাসি-খুশি আম্মুটা একদম বাচ্চাদের মতো ছিল, একটু বকাঝকা দিলেই চোখ ভিজিয়ে তাকিয়ে থাকতো! আমা’র পরিচিত অনেক মানুষ আমাকে ইনবক্সে প্রতিনিয়ত অনুরোধ করেছেন, তারা হাসপাতা’লে এসে আম্মুর সেবা করতে চান!
এই কোভিড-১৯ মহামা’রিতে তাদের অনুরোধ গ্রহণ করার সাহস আমা’র ছিল না। আমা’র আম্মুর দুই ছে’লের বউ সাবিনা এবং নিশি সব সংশয়ের কথা ভু’লে কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ডে আম্মুর পাশে বসে থেকেছে। ৩১ তারিখ আমা’র তাৎক্ষণিক অসহায় আবেদনে,
আমা’র সকল পরিচিত মানুষ, বন্ধু, কর্মক্ষেত্রের বন্ধু, অর্ধপরিচিত, অ’পরিচিত যারা পুরো শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজে আম্মুর জন্য প্লাজমা আর ই’নজেকশনের খোঁজ দিয়েছিলেন….আমি আপনাদের কাউকে ধ’ন্যবাদ দেওয়ার সুযোগটুকু পর্যন্ত পেলাম না!’
মুর্শেদ বিপুল লেখেন, ১ এপ্রিল ২০২১, ভোর ৪টায় আম্মু চলে গেল। আম্মুর স’ঙ্গে আমা’র আর দেখা হয়নি। সাবিনা আমাকে ভোর ৫টায় ঘুম থেকে তুলে খবরটা দিয়েছিল। আমা’র অনেক অ’ভিমান হয়েছিল আম্মুর ও’পরে। আমি কাত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মনেপ্রা’ণে চাইছিলাম, আমা’র এই ঘুমটা আর না ভাঙুক। আম্মুকে যখন হাসপাতাল থেকে গোসল করাতে নিয়ে গেছে,
আমা’র সবচেয়ে কাছের বন্ধু, মু’সলিমা নাজনীন নিউইয়র্ক থেকে কল দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “বিপুল, তোর অ’সুস্থতা-মন খা’রাপ যাই হোক, তুই অবশ্যই অবশ্যই আন্টির জানাজায় যাবি! এটা তোর ও’পর আন্টির হক! এটা তোর কাছে আন্টির চাওয়া! আন্টি তোর কাছে আর কোনদিন কিছু চাইবে না!’
‘সকাল ১১টা। কোভিড আ’ক্রান্ত আম’রা দুই ভাই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাতে আইভি ক্যানোলা লাগানো দেখে কেউ আমাদের আম্মুর সাথে কবরে নামতে দেয়নি। দানিয়েলের বন্ধু, লবিদ রুশদী আম্মুর স’ঙ্গে কবরে নেমেছিল, কাঁদতে কাঁদতে আম্মুর কাফনের বাঁধ’নগুলো খুলে দিয়েছিল। স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, নার্স বলেছিল, আম্মু শেষবারের মতো একবার চোখ মেলে তাকিয়েছিল। আম্মু কি ওই যন্ত্রপাতি লাগানো একলা ঘরে অনেক ভ’য় পেয়েছিল?
আম্মু কি কাউকে খুঁজেছিল একবার? আমা’র চঞ্চল আম্মুটা কি কিছু বলতে চেয়েছিল? আম্মু কি তার এই অ’প্রস্তুত যাত্রায় অনেক বেশি অ’বাক হয়েছিল? টানা তিনদিন আমি কারো ফোন রিসিভ করিনি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম, এই পৃথিবীতে কারা কারা আম্মুর জন্য চি’ৎকার করে হাউ-মাউ করে কাঁদছিল। আমি টের পাচ্ছিলাম। আমি এখনও কাঁদতে পারিনি! আমি দুঃখিত, এতো কথা বলে আপনাদের মুহূর্তটুকু ম্লান করে দেওয়ার জন্য। …’আম্মুটা ভালো থাকুক। আমি জেনেছি, হঠাৎ বলে কিছু নেই। জীবনটা আসলে এমনই; আ’নন্দ-বেদনা আর প্রার্থনায় একাকার। সবার আম্মু ভালো থাকুক, সবার ভালো হোক। একলা পাড়ের সবাই ভালো থাকুক।