ওরা মানুষের জীবন নিয়ে খেলে, দালাল নামে পরিচিত তারা। রাজধানীর যে কোনো সরকারি হাসপাতালে গেলেই এদের দৌরাত্ব দেখতে পাওয়া যায়। তারা প্রতারণার মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। তাদেরকে সহায়তা করে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মচারি-কর্মকর্তা।
অভিযোগ রয়েছে কিছু চিকিৎসকও এসব দালাল চক্রের সঙ্গে জড়িত। মাঝে-মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করলেও জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো একই কাজ করে এই দালালরা।
ডেইলি বাংলাদেশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা অধিকাংশই নিজেদের তথাকথিত ক্লিনিকের সঙ্গে জড়িত। তারা রোগী ভাগিয়ে আনার জন্য এসব দালালদের নিয়োগ করে। অসহায় রোগীদের ভাগিয়ে নিয়ে ভর্তি করায় সেই হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। এরপর অভিনব কায়দায় দালার চক্র হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা।
রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পূনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল), জতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট (এনআইসিভিডি), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল (মিটফোর্ড হাসপাতাল), সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও হাসপাতাল ও জাতীয় শিশু হাসপাতালসহ শ্যামলী এলাকার অন্যান্য হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে এসব চিত্র।
অভিযোগ রয়েছে, কর্তব্যরত চিকিৎসক থেকে আয়া পর্যন্ত কারো কাছে পাত্তাই পায়না রোগী ও স্বজনরা। প্রশাসন যদি এসব অসাধু চিকিৎসকসহ তাদের সহযোগী দালালদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয় তাহলে অসহায় রোগীরা জিম্মি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবেন। কিন্তু সে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
এই বৈশ্বিক করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তবে সেই নির্দেশের বাস্তবায়ন হয়নি তেমন। নানা ধরণের হয়রানির শিকার হচ্ছেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। এসব হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, আয়াসহ দালালচক্র আগের মতোই রোগীদের জিম্মি করে অর্থ আদায় করছে। শুধু তাই নয়, শিশু রোগীকে হাসপাতালে নেয়া হলে প্রথমেই তাদের পরীক্ষার নামে কিছু ডায়গনস্টিক সেন্টারে পাঠায় চিকিৎসকরা। এসব পরীক্ষার ফির ৪০ শতাংশ পায় চিকিৎসকরা।
এসব কারণসহ ভুয়া বিল নিয়ে সঠিক চিকিৎসা দেয়া হয়নি বলে গত মাসজুড়ে খবরের শিরোনাম হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতাল। সরকাররি হাসপাতালগুলোতে রোগী বহন করার ট্রলি পেতেও টাকা গুনতে হয় বলে জানা গেছে।
দালালরা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে খুবই কৌশলে উপস্থাপন করে- ভাল চিকিৎসা হবে, খরচ তেমন নেই শুধু ওষুধের খরচটা লাগবে। এসব বলে রোগীর স্বজনদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা রোগীদেরকেই এরা বেশি টার্গেট করে। পরে রোগীর স্বজনদের এক অর্থে জিম্মি করে ফেলে দালালরা। তাদের খপ্পরে পড়ে ভর্তি হওয়া এসব রোগী উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা পান, অনেক সময় মারা যায় রোগী। তারপর রোগীর স্বজনের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় মোটা অংকের বিল।
ফলে তারা একদিকে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হন, অপরদিকে বড় অংকের বিল মেটাতে গিয়ে মহাবিপাকে পড়েন।
এছাড়া দালালরা এমন সব ক্লিনিক বা হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে ভর্তি করায় যেখানে কোন ডাক্তারই নেই। ভুক্তভোগীরা বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়ার নামে রীতিমতো কসাইয়ের কার্যক্রম চালায় তারা। এ ধরনের হাসপাতালে ডাক্তার, ওয়ার্ডবয় আর নার্সদের গাফিলতিতে আয়ারা পর্যন্ত হয়ে ওঠেন বেপরোয়া।
গত ১৫ জুন রাত ১১ টা থেকে রাত দেড়াটা পর্যন্ত শ্যামলী এলাকায় র্যাব-২ এর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায়। অভিযানে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভুয়া ডাক্তার ও দালাল চক্রের ৬ জনকে আটক করে র্যাব। পারে তাদের প্রত্যেককে ৬ মাস করে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
তারা হলো- রেজাউল করিম, মানিক মিয়া, বিল্লাল হোসেন, কল্পনা আক্তার, মর্জিনা বেগম ও মোছা. আজিরন বেগম।এই অভিযানে র্যাব-২ এর পুলিশ সুপার মুহম্মদ মহিউদ্দিন ফারুকীর নেতৃত্বে র্যাব ২ এর একটি দল সহায়তা করে আদালতকে।
পুলিশ সুপার ফারুকী ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, এই দালাল চক্রের কাজ হলো রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, শিশু হাসপাতালসহ রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে কোনো চিকিৎসা হয় না, ডাক্তার থাকে না, ভর্তি হওয়া রোগী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে- এমন আতঙ্ক তৈরি করে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা রোগীদের ভয় দেখিয়ে তাদের ভাগিয়ে নিয়ে তাদের চুক্তি করা হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। উন্নত চিকিৎসার আশ্বাস দিয়ে নাম সর্বস্বহীন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে দালালরা। এমনকি হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে অপারেশন করে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে। এসব ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুও হয় বলে জানা গেছে।